ইরানীদের ইসলামী কর্মকাণ্ড
ইয়েমেনের ঘটনায় সেখানকার ইরানী মুসলমানদের আত্মত্যাগী ভূমিকার সবচেয়ে বড় প্রমাণ যে ,ইরানীরা উন্মুক্ত মন নিয়ে পবিত্র ইসলাম ধর্মকে গ্রহণ করেছিল এবং এ ধর্মের প্রচারে কোন আত্মত্যাগেই পিছপা হয়নি। যে সকল লেখক এ কথা বলেন ,এ জাতির ওপর তরবারীর সাহায্যে ইসলাম চাপিয়ে দেয়া হয়েছে ;হয় জাতীয়তার গোঁড়ামি তাঁদের এ কথা বলতে বাধ্য করে নতুবা তাঁরা ইরানী জাতিতে ইসলামের প্রবেশ সম্পর্কে অজ্ঞাত। সকল ঐতিহাসিক উল্লেখ করেছেন ইসলাম আশ্চর্যজনক গতিতে ইরানে প্রসার লাভ করেছিল এবং এ জাতি কোন যুদ্ধ ও বিতর্ক ছাড়াই এ ধর্মকে অভিনন্দন জানিয়েছে এবং মাত্র বিশ বছরের মধ্যেই সমগ্র ইরানের ভূমি একদিকে ফোরাত হতে যেইহুন নদীর বেলাভূমি অন্যদিকে সিন্ধু নদী হতে খাওয়ারেজম অববাহিকা পর্যন্ত ইসলাম ছড়িয়ে পড়ে। যদিও কয়েকস্থানে আরব মুসলমানদের সঙ্গে যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে তদুপরি যুদ্ধগুলো শাসকবর্গ ,ধর্মীয় গুরু ও অভিজাতদের সঙ্গে সংঘটিত হয়েছে যারা ইসলামের আগমনকে তাদের স্বার্থের জন্য ক্ষতিকর বুঝতে পেরেছিল।
বৃহৎ পারস্য সাম্রাজ্য মুসলমানদের হস্তগত হওয়ার অল্প সময়ের মধ্যেই এ দেশের অধিকাংশ মানুষ (মাযেনদারান ও দাইলামী পার্বত্য এলাকার অধিবাসীরা ব্যতীত) ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। এ দেশের মানুষ ইসলামের প্রচার ও এর পবিত্র শরীয়তের বিধানকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য ব্যাপক কর্মকাণ্ড শুরু করে। ইসলামের আবির্ভাবের প্রথম তিন শতাব্দী ইরান বনী উমাইয়্যা ও বনী আব্বাসের খলীফাদের হাতে শাসিত হয়। সে সময়েও ইরানীরা ইসলামী বিধিবিধানের ব্যাখ্যা ,আরবী সাহিত্য ,ইসলামের সামাজিক ,রাজনৈতিক ও বিচার বিভাগীয় বিষয়ে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালায় এবং বিভিন্ন মৌলিক বিষয়ের ব্যাখ্যা প্রদান করে ভূমিকা রাখে।
তদুপরি প্রথম শতাব্দীতে যখন তাফসীর ,হাদীস ,কালামশাস্ত্র ,দর্শন ও তাসাউফশাস্ত্র প্রবর্তিত হয় তখন ইরানীরা এ সকল ক্ষেত্রে প্রথম সারিতে অবস্থান নিয়েছিল। ইরানের নিশাবুর ,হেরাত ,বাল্খ ,মারভ ,বুখারা ,সামারকান্দ ,রেই ,ইসফাহান ও অন্যান্য শহর এ সকল জ্ঞানের কেন্দ্র হিসেবে অত্যন্ত কর্মতৎপর ছিল। শত শত হাদীসশাস্ত্রবিদ এ সকল শহরে শিক্ষা লাভ ও প্রশিক্ষিত হয়েছেন। তাঁরা ইসলামের উজ্জ্বল সভ্যতাকে পূর্ব-পশ্চিম সকল দিকে প্রচার ও প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টি ইরানে বিশেষত খোরাসানে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল তা হলো হাদীসশাস্ত্র। ইনসাফের সাথে বলতে গেলে হাদীসশাস্ত্রে ইরানীদের সর্বাধিক ভূমিকাকে স্বীকার করা যথেষ্ট নয় ;বরং বলা উচিত ইরানীরা হাদীসশাস্ত্রের পত্তনকারী। হাদীসশাস্ত্রবিদদের অনেকেই স্বয়ং হাদীস বর্ণনাকারীদের নিকট থেকে হাদীস শ্রবণের জন্য প্রায়শই মদীনা ,কুফা ,বসরা ,সিরিয়া প্রভৃতি স্থানে ভ্রমণ করতেন এবং এই হাদীসসমূহকে তাঁদের‘
সিহাহ’
(সহীহ হাদীস গন্থসমূহ) ও‘
মাসানিদ’
গ্রন্থগুলোতে লিপিবদ্ধ করেছেন। খোরাসানের হাদীস শিক্ষাকেন্দ্র মুসলিম বিশ্বে তৎকালীন সময়ে এতটা গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান লাভ করেছিল যে ,মিশর ,আফ্রিকা ,হিজায ,ইরাক ও সিরিয়া হতে কয়েক শতাব্দী ধরে বিভিন্ন ব্যক্তি হাদীস শিক্ষা লাভের জন্য খোরাসানের নিশাবুর ,মারভ ,হেরাত ,বালখ ও বুখারার হাদীসশাস্ত্রবিদদের নিকট আসতেন।
যাঁরা হাদীস ,মুসনাদ ,সিহাহ ও মাশায়িখদের (বিভিন্ন হাদীস শিক্ষক যাঁরা সরাসরি হাদীস শুনেছেন ও সংকলন করেছেন) বিষয়ে জানেন তাঁরা অবগত আছেন ,আহলে সুন্নাতের সকল হাদীস সংকলক এবং শিয়া মাযহাবের প্রসিদ্ধ চার গ্রন্থের সংকলক ইরানী। হাদীস সংকলকদের মধ্যে শেখ তুসী ,মুসলিম নিশাবুরী ,আবু আবদুর রহমান নাসায়ী ,মুহাম্মাদ ইবনে ইসমাঈল বুখারী ,আবু দাউদ সাজেস্তানী ,তিরমিযী ,বায়হাকী এ সাত ব্যক্তি খোরাসানের ,শেখ সাদুক কোমের এবং ইবনে মাযা কাযভীনের। এ প্রসিদ্ধ ব্যক্তিদের ছাড়াও কয়েকশ’
হাদীসশাস্ত্রবিদ ইরানী ছিলেন। প্রসিদ্ধ মুসলিম দার্শনিক ,কালামশাস্ত্রবিদ ,ঐতিহাসিক ,আরবী অভিধান রচয়িতা ,আরবী ভাষায় প্রসিদ্ধ কবিতা রচনাকারী ,মুফাসসির ,রাজনীতিবিদ ,সম্রাট ও পর্যটকদের অধিকাংশই ইরানী ছিলেন। যেমন বার্মাকীরা ,নওবাখতী ,কাশরীয়ান ,সামানীয়ান ,তাহেরীয়ান ,আলেবুইয়া ,গজনভী ,ঘুরী ,খাজা নেজামুল মুলক ,সায়েদীয়ান ,খাজা নাসিরুদ্দীন ,সামআনী ,সারাবদারানসহ অসংখ্য শাসক যাঁরা ইসলামী সভ্যতার প্রচার ও বিকাশে ভূমিকা রেখেছেন তাঁরা ইরানী ছিলেন।
আহলে সুন্নাতের প্রসিদ্ধ চার ইমামের দু’
জন ইরানী এবং উভয়ই খোরাসানের। তাঁদের প্রথমজন হলেন আবু হানিফা যিনি নিসা (দারগেয) ,কারো কারো মতে কাবুলের লোক ছিলেন। দ্বিতীয় ব্যক্তি হলেন আহমাদ ইবনে হাম্বাল। তিনি খোরাসানের মার্ভে জন্মগ্রহণ করেন ও বাগদাদে বয়ঃপ্রাপ্ত হন।
সার্বিকভাবে ইরানীরা প্রথম কয়েক শতাব্দীতে ইসলামী সংস্কৃতি ও শিক্ষাকে শক্তিশালী মৌলনীতি ও ভিত্তির ওপর স্থাপন করে এবং আগামী প্রজন্মের জন্য পথ উন্মুক্ত করে দিয়ে যায়। যেহেতু বিষয়টি খুবই পরিষ্কার সেহেতু বিস্তারিত আলোচনা হতে বিরত থাকছি।
চতুর্থ হিজরী শতাব্দীর ঊষালগ্নে ইরানের উত্তরাঞ্চলের তাবারিস্তান ও গিলান মুসলমানদের
হস্তগত হয়। এ শতাব্দীতেই ইরানীরা রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জন করে এবং সামানিগণ বাগদাদের খলীফার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে খোরাসান ও পূর্বাঞ্চল নিয়ে স্বাধীন রাজ্য গড়ে তোলে। কারণ ধর্মীয় জ্ঞানের জন্যও তাদের খেলাফতের ওপর নির্ভর করার প্রয়োজন ছিল না।